,

দু’বছর পর ফিরল ‘কান্নাকাটির মেলা’

জেলা প্রতিনিধি, লালমনিরহাট:  লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের ঘোঙ্গাগাছ সীমান্তে  প্রতিবছর চৈত্র মাসে একটি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আসলে এর নাম সীমান্ত মেলা হলেও মানুষের মুখে মুখে তা পরিচিতি পেয়েছে  ‘কান্নাকাটির মেলা’ নামে।

তবে করোনার কারণে দু’বছর বন্ধ ছিল মেলার আয়োজন। দু’বছর গেল বুধবার অনুষ্ঠিত হলো এ মেলা। আর এতেই ভারত-বাংলাদেশের হাজারো নারী-পুরুষ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। আর একেকজনকে দেখতে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। চলে উপহারসামগ্রী বিনিময়ও।

স্বজনের টানে ছুটে এসেছিলেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা নমিতা রানীও। মেয়ের সঙ্গে তার দেখা হয় না প্রায় ১২ বছর। করোনার আগে ভিসা পেয়েছিলেন, যাওয়া হয়নি, ইতোমধ্যে মেয়াদ শেষ হয়েছে। তাই এভাবে দেখা করার সুযোগ পেয়ে খুশি নমিতা রানী।

শ্যামে পূজা উপলক্ষে আয়োজিত এপার-ওপার বাংলার লাখো বাঙালির মিলন মেলায় সম্পর্কের টানের কাছে যেন হার মানে কাঁটাতারের বেড়া। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিভক্তি ভুলে পাসপোর্ট-ভিসা, অবৈধ অনুপ্রবেশ, বিজিবি-বিএসএফের বাধা-সবকিছু উপেক্ষা করে বাংলাদেশ-ভারতের নারী-পুরুষ, শিশু-যুবক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার উপচেপড়া এ ঢল শুধুই উচ্ছাস আর আবেগের।

কুড়িগ্রাম থেকে আসা অজয় কুমার বলেন, প্রায় ১৬ বছর আগে মেয়ের বিয়ে দেন দিনহাটাতে। কিন্তু  অভাব আর অনটনের কারণে ভারতে গিয়ে দেখা করতে পারেননি তারা। এবার সুযোগ পেলেও কাঁটাতারের ব্যবধানে হাত ছোঁয়া হলো না। এপারে দাঁড়িয়ে ওপারে মেয়ে ও স্বজনদের দেখা আর কথা বলার সুযোগ পেলাম। আর কিছু দিতে পারলাম না।

বৃদ্ধ প্রতাপ চন্দ্র রায় (৭৫) তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র রায়ের (৪৮) সাথে এসেছিলেন মেয়ে নারায়নী রানীর (৪৫) সাথে দেখা করার জন্য। নারায়নী বিয়ে করে ভারতে বসবাস করছেন। চার বছর পর মেয়ের সাথে দেখা হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রতাপ চন্দ্র। মেয়ে নারায়নীও কান্নায় ভেঙে পড়েন। বাবা-মেয়ে একে অপরের গলা জড়াজড়ি করে বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করেন।

প্রতাপ চন্দ্র রায় বলেন, আমার শরীরের অবস্থা ভালো নেই। যেকোনো সময় মারা যেতে পারি। তাই মরার আগে মেয়ে নারায়নীকে দেখার জন্য সীমান্তে কান্নাকাটির মেলায় আসলাস। মেয়েকে কিছু খাবার উপহার দিয়েছি। মেয়েও আমার জন্য খাবার এনেছিল। আমাদের পাসপোর্ট করার সামর্থ্য না থাকায় সীমান্তে মেলায় আসি।

প্রতাপের মেয়ে নারায়ল রানী (৪৫) বলেন, প্রায় ২৮-২৯ বছর আগে ভারতীয় নাগরিকের সাথে তার বিয়ে হয়। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার সিতাই থানার গোবিন্দপাড়া গ্রামে বসবাস করছেন। চার বছর পর তিনি তার বাবাসহ বাংলাদেশি আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করার সুযোগ পেলেন।

ভারতীয় নাগরিক সুরেশ চন্দ্র রায় বলেন, আমার অসংখ্য আপনজন বাংলাদেশে বসবাস করছেন। ভারতেও আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। আপনজনদের ছেড়ে কষ্টে বসবাস করছি। অনেক দিন পর দাদাসহ বাংলাদেশি আত্মীয় স্বজনদের দেখা হওয়ায় আমি খুশি হয়েছি। মাঝে মধ্যে এই ব্যবস্থা করলে গরীব মানুষ গুলোর সুবিধা হয়।

সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশি ও ভারতীয়রা বলেন, উভয় দেশের নাগরিক মালদহ নদীতে পুণ্য স্নান করেন। বিশেষ করে ভারতীয় নাগরিকরা কাঁটাতারের বেড়ার পাশে ভেরভেরি এলাকায় গঙ্গাপূজা করার পর মালদহ নদীতে পূণ্য স্নান করে থাকেন। করোনা মহামারির কারণে গেল দুই বছর সীমান্ত মেলাটি বন্ধ থাকায় এ বছর দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় ছিল।

গোড়ল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, মিলনমেলায় লালমনিরহাটসহ পাশের জেলা রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েক হাজার বাংলাদেশি এসেছিলেন। অধিকাংশ মানুষ এসেছিলেন ভারতে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করার জন্য। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে মেলাটি শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর